মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ (১৯৭৫-১৯৮১)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - সামরিক শাসন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ (১৯৭৫-১৯৯০) | | NCTB BOOK

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার দশ দিনের মাথায় ২৫শে আগস্ট জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। পরবর্তীকালে সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়া পদচ্যুত ও বন্দী হন। বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়া পুনরায় সেনাপ্রধান হলেও মোশতাকের রাষ্ট্রপতি পদে ফিরে আসাকে সমর্থন জানাননি বরং জিয়া নিজে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর খন্দকার মোশতাক সংবিধান লঙ্ঘন করে নিজে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। এরপর ২৫শে আগস্ট খন্দকার মোশতাক সেনা বাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে জিয়াউর রহমানকে নিযুক্ত করেন। ৩রা নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাকের পতন ঘটে এবং জিয়া পদচ্যুত ও গৃহবন্দী হন। ৭ই নভেম্বর পাল্টা সেনা অভ্যূত্থান ঘটে এবং জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। লক্ষণীয় বিষয় হলো রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক উভয়ক্ষেত্রেই বিচারপতি সায়েম ছিলেন ক্ষমতাহীন। মূল ক্ষমতা ছিল জিয়ার হাতে। ১৯৭৬ সালের ৩০শে নভেম্বর জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল জিয়া জোরপূর্বক রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। তার শাসন আমলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে অনেকগুলো ব্যর্থ অভ্যূত্থান সংঘটিত হয়। এতে বিচারের নামে জিয়া অনেক নিরাপরাধ সামরিক কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা, চাকরিচ্যুতি, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেন।

১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭২-এর সংবিধানে যেসব মৌলিক নীতি ও চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়ে আসছিল, তার বেশিরভাগই জিয়ার সময়ে বাতিল করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গকে তিনি সমাজ ও রাজনীতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন । ১৫ই আগস্টসহ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না মর্মে যে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' প্রণীত হয়েছিল তার মূল হোতাও ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এলে ১৯৯৬ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন' প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক । আর সেই সঙ্গে সুগম হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ ।

৭ই নভেম্বর জিয়াকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী কর্নেল (অব.) আবু তাহেরকে ১৯৭৬ সালে সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচার শেষে জিয়ার আদেশেই ফাঁসি দেওয়া হয়। অবশ্য ২০১১ সালের ২২শে মার্চ হাইকোর্ট সামরিক আদালতে কর্নেল আবু তাহেরের বিচারকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে। রায়ে বলা হয়, ঐ সামরিক আদালত গঠন এবং বিচার কার্যক্রমের সবকিছুই অবৈধ।

১৯৭৭ সালের ৩০শে মে জিয়া তার ক্ষমতা বৈধকরণের লক্ষ্যে হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করেন। এরপর তিনি নিজস্ব পরিকল্পনা মতো সামরিক ছত্রছায়ায় বিভিন্ন দল থেকে আদর্শহীন এবং সুবিধাবাদী নেতাকর্মীদের নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠন করেন। এসময়ে রাজনৈতিক দল ভাঙা-গড়ার কাজও চলে। পরিশেষে চাপের মধ্যে ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক শাসনাধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শাসকের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে। সুতরাং নির্বাচনে জিয়াউর রহমান সহজেই বিজয় অর্জন করেন। ইতোমধ্যে সামরিক ছত্রছায়ায় জিয়াউর রহমান গঠিত জাগদল বিলুপ্ত করে প্রথমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন এবং নিজে তার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একতরফা এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জয়লাভ করে। উক্ত সংসদে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ যে সকল সামরিক বিধি, সংবিধান সংশোধনসহ বিভিন্ন অন্যায় ও অবৈধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী অধ্যাদেশ জারি করা হয়, সেগুলো সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে পাস করে বৈধতা দেওয়া হয়। অবশ্য ২০০৮ সালে এক রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়। বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া চালু করে রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের পুনর্বাসন করেন। তিনি সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করেন। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের পথ তৈরি করেন। জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের নিজস্ব মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও কুক্ষিগতকরণ এবং তার অপরাপর কর্মকাণ্ড থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী ও সুবিধাবাদী সামরিক কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনার সাথে যুক্ত আত্মস্বীকৃত খুনিদের গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জিয়া ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের খুবই আস্থাভাজন এবং তিনি এ জঘণ্য হত্যা পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্বেই অবগত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ার সময় এ সংক্রান্ত আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে এই সময়ে স্বীকৃতি প্রদান করে। পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা সমর্থনকারী ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহের সঙ্গে এ সময়ে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয় ।

প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা জিয়াউর রহমানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। দেশে রাজনীতিতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ থাকলেও বড় কোনো আন্দোলন তাকে মোকাবিলা করতে হয়নি। দমন-পীড়ন আর ভয়ভীতির কারণে বিরোধী দল তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি । তবে সামরিক বাহিনীর মধ্যে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে প্রায় সতেরোটি অভ্যুত্থান হয় । প্রতিবার তিনি বিদ্রোহী অফিসারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত শত শত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড এবং চাকরিচ্যুত করা হয় । তারপরও সেনাবাহিনীর ভেতর থেকেই তার জীবনের ওপর আক্রমণ এসেছে। চট্টগ্রামে ১৯৮১ সালের ৩০শে মে সার্কিট হাউসে এক অভ্যুত্থানে তাকে হত্যা করে কতিপয় সেনাসদস্য ।

Content added By
Promotion